প্রস্তাবিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এবং বাস্তবতা

প্রস্তাবিত  জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এবং বাস্তবতা
                                                                        শরিফুল ইসলাম সেলিম
ভূমিকা:
লিঙ্গসমতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের বিশ্ব নারী সম্মেলনে বেইজিং কর্মপরিকল্পনায় ১৯৯৫ সালে স্বাক্ষর করার ১৬ বছর পর বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে তার নারী উন্নয়ন নীতি চূড়ান্ত করেছে। এর আগে বিভিন্ন নারী সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালে যে নীতিটি প্রণীত হয়েছিল, তা কার্যকর হয়নি। পরে সেটি বিভক্ত রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। নারী উন্নয়ন নীতির ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, ২০১১ সালের এই নীতিটি কেন নারীদের অধিকারের স্বীকৃতির ব্যাপারে রক্ষণশীল রয়ে গেছে; দেখা যাবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও রক্ষণশীলতা কীভাবে এর বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে
বেইজিং সম্মেলনের দুই বছর পরে প্রণীত ১৯৯৭ সালের নীতিটির বাস্তবায়ন পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত শুরুই হয়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট২০০৪ সালে নারীনীতিটি খুব গোপনে পরিবর্তন করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনায় জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৪শিরোনামে প্রকাশিত হয়।  কারণ, লিঙ্গসমতা নিয়ে সরকারি প্রচারনা চলেছে আগের মতোই। খালেদা জিয়া তাঁর মেয়াদকালজুড়ে জনসমক্ষে বক্তৃতায়-ভাষণে নারীসমাজের উন্নয়নে তাঁর সরকারের অবদানের কথা উল্লেখ করতে কখনোই ভোলেননি। আর তাঁর মহিলাবিষয়কমন্ত্রী নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনসংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিটির (ইউএনসিডও) কাছে ২০০৪ সালে পেশ করা বাংলাদেশের পঞ্চম প্রতিবেদনে নারীর সম-অধিকারের পথে অবশিষ্ট বাধাগুলো দূর করতে তাঁর সরকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় বিবাহ, সম্পত্তি, নাগরিকত্ব ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ২০০৮ সালে নতুন নারীনীতির ঘোষণা দেন। তার ফলে ইসলামী ঐক্যজোট (চারদলীয় জোটের শরিক) ইস্যুটি নিয়ে রাস্তায় নামার সুযোগ পেয়ে যায়। তাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে সুর মেলান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনজন উপদেষ্টা। নারী অধিকার আন্দোলন আরও একটা ধাক্কা খায়।বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় এসে ১৯৯৭ সালের ঘোষিত নীতিমালাকে কিছুটা সংস্কার করে আবার নতুন করে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ ঘোষণা দিয়েছে।

কি আছে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ তে?
নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে নতুন নীতি পাওয়া যাচ্ছে সেই নীতি পড়ে জানতে পারছি নারী উন্নয়ন নীতিতে আসলে কী আছে!  ২৮পৃষ্ঠায়  তিনটি ভাগে মোট ৪৯টি ধারা আছে এই নীতিমালায়। সম্পূর্ণ বাংলা শব্দে, স্পষ্টভাবে সহজ ভাষায় এটি লিখিত। এই নীতিমালার কোথাও ধর্ম বিরোধী শব্দ নেই, তথ্য নেই, তত্ত্ব নেই এবং পদক্ষেপ নেই।মূলত বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর যেসব অধিকার ও সুযোগ রয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘ নারীসনদে যেসব ধারা রয়েছে তারই আলোকে সরকারের নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ উল্লেখ যোগ্য ধারা সমূহ নিম্নরুপঃ
           
১. বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা(১৬.১)
২.নারী-পুরুষের সমান বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা।’ (১৬.৮)
৩. স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন  ধর্মের কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন  বিরোধী কোন বক্তব্য বা অনুরূপ কাজ বা কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করা(১৭.৫)
৪. বৈষম্যমূলক কোন আইন প্রণয়ন না করা বা  বৈষম্যমূলক কোন সামাজিক প্রথার  উন্মেষ ঘটতে না দেয়া(১৭.৬)
৫. সম্পদ, কর্মস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া। (২৩.৫)
৬. উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।’ (২৫.২)
৭. নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি ও নীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। (২৬.৬)

প্রকৃতপক্ষে আমাদের সংবিধানে নারীর যে সকল অধিকার স্বীকৃত আছে মূলত এসব অধিকার তারই বহিঃপ্রকাশআমাদের সংবিধানে যে সকল অধিকার স্বীকৃত আছে

১. সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” (২৭ অনুচ্ছেদ)
২.কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী বর্ণ নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।”) (২৮(১) অনুচ্ছেদ)
৩. রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী, পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন। (২৮(২) অনুচ্ছেদ)
৪. কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্বাসের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের  অধীন করা  যাইবে না।” (২৮(৩) অনুচ্ছেদ)
৫. নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের  যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের  কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।” (২৮(৪) অনুচ্ছেদ)
৬. প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে কোন নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।” [২৯(১)]
৭. কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।” [২৯(৩)]
সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ৪৫টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ৯ অনুচ্ছেদের অধীনে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নয়নে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ কি প্রকৃতপক্ষে ধর্মের বিরুদ্ধে ?
আমাদের সংবিধান ও জাতিসঙ্ঘ সনদকে সমন্বয় করে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১  প্রণীত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এখানে ধর্মের কোন বিরোধিতা ও  ব্যাখ্যাও আসেনি। কিন্তু হৈ চৈ হচ্ছে প্রচুর কারণ, তাঁদের দাবি, ধর্মের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় বিধিবিধান লংঘন করে নারীদের সম্পত্তিতে নাকি অধিকার দেয়া হয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে নিশ্চয়ই শুধু ইসলাম ধর্মের বিধিবিধানের বিরুদ্ধে বিপদটি ঘটেনি, ঘটেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্য সকল ধর্মের ক্ষেত্রেও। কোন ধর্মেরই ধর্মীয় বিধি বিধানে নারী-পুরুষের সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে সম-অধিকার নেই। কিন্তু অন্য ধর্মের দিক থেকে কোন সমস্যা বা আপত্তি দেখা যাচ্ছে না এমনকি সকল ইসলামী দল যে বিরোধিতা করছেন তাও নয়।
আজকের বিশ্বে নারীর প্রতি সকল  বৈষম্য-বঞ্চণা-শোষণ দূর করে  পুরুষের সম-অধিকার ভোগ করা ও সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা নিয়ে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১  প্রণীত হয়েছে বলে,বলা হচ্ছেআপাতদৃষ্টিতে এখানে ধর্মের কোন বিরোধিতা ও  ব্যাখ্যাও আসেনি।  যুগ যুগ ধরে আমাদের মেয়েরা ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও নানা কুসংস্কারের শিকার হয়ে শোষিত, বঞ্চিত নির্যাতিত, অবহেলিত পশ্চাৎপদ থেকেছে। তাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কেউ তাকায়নি। বরং পুরুষ প্রধান সমাজ ব্যবস্থায় তাকে পুরুষরাই নিয়ন্ত্রণ করেছে, ভোগ ও বিনোদনের সামগ্রী করেছে। নারীকে পতিতাবৃত্তিতে নামিয়েছে, পাচার করেছেআর একদল নারীকে বিবাহ করেছে ক্রীতদাসী  ও সন্তান জন্মের যন্ত্র বিবেচনা করে। এই তো পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থার চিত্র। আরব দেশে কন্যা জন্মালে হত্যা করা হতো নারীকে শুধুমাত্র ক্রীতদাসী ও ভোগের সামগ্রী বিবেচনা করা হতো। নারী কেনা-বেচাও হতো। ইসলাম র্ধম এসে নারীকে সেই অন্ধকার থেকে সামান্য একটু তুলতে সমর্থ হয়।  নারীকে তার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় নূন্যতম নির্দেশ দিয়েছে। এই নূন্যতমটা সেই সময়কার পুরুষরাও দিতে চায়নি। আর আজকের বিশ্বে সভ্যতা এগিয়েছে, মানবতা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে
নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১-এর লক্ষ্যসমূহ কোথাও কোন ধর্ম বিরোধী কথা বলা হয়েছেএটা মূর্খ, নারী বিদ্বেষী, ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউ উচ্চারণ করতে পারে না। যারা প্রকৃত ধর্মচর্চা করেন, ধর্মীয় আদর্শ মেনে চলেন তারা সংবিধান প্রদত্ত অধিকার ভোগ করছেন, শিক্ষার্জন করছেন ও চাকুরিতেও নিয়োগলাভ করছেন। তারা তো কোন বাধা বা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন একথা তো শোনা যায় না।কিন্তূ ঘোষিত নারী নীতিমালার বিরোধিতা করে  আমাদের ধর্ম ব্যবসায়ীরা মাঠে নেমেছেন। এরা ধর্ম গেল ধর্ম গেল চীৎকার করে চলেছেন, কিন্তু কোথায় গেল? ধর্ম তো আমাদের হৃদয়ে গাঁথা, ধর্ম তো আমাদের অনুভূতি, ধর্ম তো আমার প্রাত্যহিক চর্চা, আমাদের জীবনাচরণের সঙ্গে জড়িত। তাহলে ধর্মটা কোথায় গেলো, কীভাবে গেলো?

বিরোধিদের বিরোধিতা কেন এবং কোথায় ?

ইসলাম পূর্ব  যুগে আমরা দেখেছি বিবি খাদিজা বিধবা হয়ে স্বামীর  রেখে যাওয়া ব্যবসা নিজে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (দ:) কে তার ব্যবসা  দেখাশোনার কাজে নিয়োগ করেন। পরে তার সততা, আদর্শ ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করেন এবং তিনিই প্রথম মানুষ যিনি  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিবি খাদিজা বিশাল সম্পত্তি অর্জন ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেনএতো এক মহা অনুসরণীয় আদর্শ আজকের নারীর কাছে। তাহলে এই তথাকথিত ধর্মবাজরা কেন নারীকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হতে দেবে না। নারী ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক, সম্পদশালী হোক, ক্ষমতাসীন হোক, মেধা ও শ্রম শক্তি দ্বারা অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হোক এটা তারা চায় না। আমাদের সংবিধান, জাতিসঙ্ঘ সনদ, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি -২০১১ বাংলাদেশের নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। এগুলো যদি যথাযথ ভাবে কার্যকর করা হয়, তাহলে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর হবে-মানব উন্নয়নেও আমরা সভ্যতার ইতিহাসে স্বাক্ষর রাখতে পারবো। এই দূর্জন, দূর্মুখ ব্যক্তিবর্গের কারণে নারীরা যুগে যুগে অবদমিত থেকেছে আমরা এবার সামনে এগোতে চাই নারীর ভাগ্য জয় করার লক্ষ্যে এবং নারী-পুরুষের বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে আদর্শ বাঙালি সমাজ গঠন করতে। যেখানে ধর্ম-শিক্ষা-সংস্কৃতি-উন্নয়ন আমাদের জীবনযাপনে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারবে না। আমরা সবাই যেন মানুষ হই, মনুষত্ব ও বিবেকের আলোকে আমরা যেন পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে মানবিক অবদান রাখতে পারি। শুধু নারী নয়, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠুক উন্নততর জীবনাদর্শে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মানব সম্পদের উন্নয়নে বিশ্বাসী। পরিবারে ও সমাজে উন্নয়নের স্পর্শ থেকে নারী পুরুষ শিশু কাউকে বঞ্চিত, অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ দেখতে চাই না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ধর্মকে পুঁজি করে যারা মানুষকে নিপীড়ন ও অবদমিত রাখতে চায়, তারা শুধু মানুষেরই শত্রু নয়, ইসলামেরশত্রু

প্রস্তাবিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ কতটুকু নারী বান্ধব ?

গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে নারী নীতিতে দেশের বঞ্চিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত নারী সমাজের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে নি।যা দেশের বিভিন্ন নারী সংগঠনগুলো দাবি করছে। আশ্চর্য্য যে তাদের এই আপত্তির প্রশ্নে সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই।আমি মনে করি, ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’-র বিরুদ্ধে নারী সংগঠনগুলোরই প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল। তাছাড়া এই নীতি ঘোষণার আগে সরকার, বা নির্দিষ্টভাবে বললে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি, সকল নারী সংগঠন (দল মত নির্বিশেষে), সামাজিক সংগঠন, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীসহ সংশ্লিষ্টদের একটি সভা ডেকে মত বিনিময় করার দরকার ছিল। দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে আমরা গণতান্ত্রিক আচরণ পাই নি। এটা দেখতে খুব অদ্ভুত লাগে যে এই দেশে সম্পত্তিতে নারীকে সমধিকার দেয়া হবে না, এই বিষয়টি প্রকাশ্যভাবে এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন নারীর অধিকারের ব্যাপারে এখন সকল কাজ-কারবার বন্ধ করে দিতে হবে। মনে হয় পুরুষতান্ত্রিক সরকার নিজেই নারীকে সেই সমধিকার দিতে চায় না বলে ধর্মীয় গোষ্ঠীর ডাকা হরতালে খুব কাহিল ভাব দেখাচ্ছেন। আসলে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের কথা বা প্রতিশ্রুতির কিছুই এই নীতিতে নাই। দাড়ি, কমার মধ্যে ২৫.২ ধারায় উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদানকরার কথা বলা হয়েছে। এতে আইনীভাবে নারী কতটুকু সম্পদ অর্জন করতে পারবে জানি না, কিন্তু একই বাক্যে সব কথা ঢূকিয়ে দিয়ে নারীর নিজের অর্জিত সম্পদও হাতছাড়া করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইভাবে ২৩.৫ নিয়েও হরতাল আহবানকারীরা আপত্তি তুলেছে। এখানে আছেসম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়াএই ২৩ অনুচ্ছেদটির শিরোনাম হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় ও সম অধিকার নিশ্চতকরণ। এখানে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার বিষয়ে কিছুই বলা নাই। তাছাড়া কিভাবে নারীর সমান সুযোগ ও অংশীদারীত্ব কায়েম হবে তার কোন ইঙ্গিত কোথাও দেয়া হয় নি। এগুলো কথার কথাই হয়ে থাকবে
সরকারের কৌশলগত অবস্থান
৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে ৭ মার্চ ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতির মোড়কে নতুন যে নারী উন্নয়ন নীতির খসড়া অনুমোদন করা হয় মন্ত্রিপরিষদে, অনুমোদন শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব সাংবাদিকদের যে তথ্য জানান; খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদে তা ছিল এমন: প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতিমালায় উত্তরাধিকার সম্পদে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে| নারী উন্নয়ন নীতির খসড়া যাদের কাছে আছে, তারা একটুখানি উল্টে পাল্টে দেখলেই বুঝবেন, সংবাদ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে কীরকম প্রতারণাময় তথ্য পরিবেশন করেছে সরকার, যার প্রধান একজন নারী এবং সেটা খোদ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যেই।তাহলে, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার বিষয়ে কোথায় বলা হলো? সরল প্রশ্ন আসতেই পারে, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক শেষে উত্তরাধিকার সম্পদে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের তথ্য কিসের ভিত্তিতে দিলেন?
খুব আশ্চর্য হতে হয়, ১৯৯৭ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে যা বলা হয়েছে, ২০১১তে তা থেকে লাফ দিয়ে সরে এসেছে এখনকার সরকার। তখনো কিন্তু সরকারে এই আওয়ামী লীগই ছিলো। তাতে বলা আছে:
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরী বিষয়াদি যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা, উপার্জনের সুযোগ, উত্তরাধিকার সম্পদ, ঋণ প্রযুক্তি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদসহ ভূমির ওপর অধিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ ও সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া এবং সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।১৩ বছর পর সেই আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন হবার পর আবার নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করতে গিয়ে, কেন আগের সাহসটুকুও ধরে রাখতে পারলো না?


বিরোধীদলের অবস্থান
১৯৯৭ সালে যে নীতি প্রণয়নে সকল নারী সংগঠন একত্রে কাজ করেছে, সেই নীতি এতো বছর ধরে বারে বারে কাঁটাছেড়া হওয়ার পর এবং কেন জানি গোপনে, কিংবা বলা যেতে পারে সকলের মতামত না নিয়ে, ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট। ২০০৪ সালে নারীনীতিটি খুব গোপনে পরিবর্তন করে মহিলা শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনায় জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৪শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৭ সালের নীতিটির , , ১২ ধারা সংশোধন করা হয়। এর ফলে সম্পত্তি, জমি উত্তরাধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে নারীদের অধিকার অস্বীকার করা হয়, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ সীমিত করা হয়, বয়স্ক নারীদের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণের অবনমন ঘটানো হয়। এই উল্টোমুখী যাত্রা নারী আন্দোলনের কর্মীদের বিস্মিত করে। খালেদা জিয়া তাঁর মেয়াদকালজুড়ে জনসমক্ষে বক্তৃতায়-ভাষণে নারীসমাজের উন্নয়নে তাঁর সরকারের অবদানের কথা উল্লেখ করতে কখনোই ভোলেননি। আর তাঁর মহিলাবিষয়কমন্ত্রী নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনসংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিটির (ইউএনসিডও) কাছে ২০০৪ সালে পেশ করা বাংলাদেশের পঞ্চম প্রতিবেদনে নারীর সম-অধিকারের পথে অবশিষ্ট বাধাগুলো দূর করতে তাঁর সরকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় বিবাহ, সম্পত্তি, নাগরিকত্ব রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের কথা। সেসব অঙ্গীকার যে পূরণ করা হবে এমন প্রত্যাশা ছিল না। নারীনীতিতে প্রকাশিত পরিবর্তনগুলো বিএনপির উগ্রপন্থী শরিকদের কাজএমন সন্দেহ ছিল। আর এখনতো খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট  পুরোপুরিই বিপরীত মেরুতে মৌলবাদীদের সাথে সুর মিলিয়ে প্রকাশ্য বিরোধীতা করছে।

উপসংহার
আপাত দৃষ্টিতে প্রস্তাবিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ পুরোপুরি নারী বান্ধব না হলেও মন্দের ভালো হিসেবে এর বাস্তবায়ন অতীব জরুরী ।আর তাছাড়া সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সব দেশেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে আছে আমাদের সংবিধানে যে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা আছে, সেটাও কোরান অনুযায়ী সাংঘর্ষিক বলে দীর্ঘদিন ধরে দাবী করে আসছে বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠিএই সাংঘর্ষিকঅবস্থানের একটা সমাধান সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগে বার বার উচ্চারিত হচ্ছেসাংবিধানিকভাবে তার মীমাংসা ছাড়া এর অন্য কোন পথ নাই। আমাদের দেশে এর মীমাংসা করার জন্য যে জাতীয় প্রক্রিয়ার প্রয়োজন তা না করে আমরা কেবল সংঘাত ও বিরোধ সৃষ্টি করে  যাচ্ছি। ইসলাম ধর্ম নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কথা বলে না, বরং অধিকার দেয়ার জন্যই নানা বিধান রেখেছে। সেক্ষেত্রে সময় এবং অবস্থা অনুযায়ী আইন পরিবর্তন করা যেতে পারে কিনা সেই বিষয়ে ধর্মীয় সহ সকল  গোষ্ঠীর সাথে আলাপ আলোচনা করা েতে পারেকিন্তু এমন কোন চেষ্টা আমরা দেখি না। সেই কারণে নারী অধিকারের বিষয়ে একটা বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হয় অথচ পুরুষদের মধ্যে অনেকেই নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলছেন এবং আন্তরিকভাবে নিজের কন্যা ও বোনকে সম্পদের অধিকার দিতে চাইছেন। তাহলে এই বিরোধ কার সাথে? এবং কেন?



(ছাত্র,শেষ বর্ষ,আইন বিচার বিভা,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন