মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১১

কাঁটাতারের বলি : ফেলানী

নাম তার ফেলানী। বয়স পনেরো হয়ে গেছে। মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে বর্ডারের কাঁটাতার পেরিয়ে ভারতে গিয়েছিল। বাবা সেখানে মজুরের কাজ করতো। দরিদ্র ঘরের মেয়ে। তবে সে যে বাপের সঙ্গে বাধ্য হয়ে গিয়েছিল সেটাই সত্য ও বাস্তব কথা।
কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্ত এলাকায় বানারীভাটা গ্রামের নূর হোসেনের মেয়ে ফেলানী। গত ৭ জানুয়ারী সে পিতার সঙ্গে কাঁটাতার পেরিয়ে ঘরে ফেরার পথে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়। ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশের ছবিটি দেখে যে কোনও মানুষই ক্ষুদ্ধ হবে, ধিক্কার দেবে। পত্রিকার খবর ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল বলে তার বাবা তাকে নিয়ে আসছিল।
বাংলাদেশ ভারতের অনেক অংশই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আবার অনেক অংশই খালি শুধুমাত্র ইট দিয়ে চিহ্ণিত করা আছে। কাঁটাতারে ঘেরা বেশ উঁচু পর্যন্ত। পেটের দায়ে হোক, চিত্তের আনন্দে হোক, চোরা কারবারের স্বার্থে হোক – এসব অবৈধ পথেই যাতায়াত করে থাকে অনেকে। বর্ডার এবং কাঁটাতারের ভয় এদের থাকে না। যেতে হবে, তা সে যেমন করেই হোক এদের মনে কোনও শঙ্কা থাকে না। প্রভাবশালীরা অর্থ দিয়ে পার যায়। আর যারা অর্থ দিতে পারে না, তাদের ভাগ্যে জোটে বুলেট। বৈধ পথেও কি যাওয়া খুব সহজ ? পাসপোর্ট তৈরি ও ভিসা পাওয়া মানে অনেক টাকার মামলা। ঝামেলা সামলে পাসপোর্ট পাওয়া গেলেও আবার ভিসার জন্যও নানা ফ্যাকরা। কত কাগজপত্র লাগে কত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। সঙ্গে বিদেশি টাকাও নিতে হয়। এতো কিছু করা সাধারণ মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়।

বৈধ পথের এইসব নানা নিয়ম কানুনের বেড়াজাল পেরিয়ে যারা যেতে পারেন তারা তো অবশ্যই ভাগ্যবান। কিন্তু একেবারে দারিদ্র ও সাধারণ মানুষ কোনও উপায় না দেখে এই অবৈধ পথের আশ্রয় নেয়। কাঁটাতারের বেড়া বা নিরাপত্তা নিয়ম নীতির কোনও পরোয়া তারা করে না। আর চোরাকারবারী ও পাচারকারীরা তো অর্থের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে কাজ সারে। সেখানে তারা খাদ্য-বস্ত্রসহ নানা মালপত্র নিয়ে যাওয়া আসা তো করেই আবার নারী, শিশু ও গরু পাচার করে মোটা অর্থের কারবার করে থাকে। এসব বন্ধের জন্য উভয় পক্ষের সরকারি উদ্যোগ মাঝে মাঝে পত্রিকায় আসে সত্য কিন্তু বন্ধ হয় না।
আমাদের দেশের গরীব ঘরের মেয়ে ফেলানী অবৈধ পথেই যাতায়ত করতো। কাঁটাতারের বেড়া পার হতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এবারে সে ধরা পড়ে যায় নিরাপত্তা রক্ষীদের চোখে। ফলে তার ভাগ্যে জোটে বুলেট নামক নিষ্ঠুর নৃশংস আঘাত। এ আঘাতে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয় কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে। নিরাপত্তা প্রহরী তার কাজ করেছে, কেন এমন অবৈধভাবে মানুষ চলাচল করবে ? তারা তাদের আইন শৃঙ্খলা বা নিয়ম নীতির আদর্শ অনুসারী। তাদের কাছে মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় থাকে না। সে বিবেচনা থাকলে তো আর ফেলানী মারা যেত না। আমি জানি না সরকারিভাবে যখন দুদেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বসেন তখন তারা মানবাধিকার বলে কোন বিষয় আলোচনায় রাখেন কি না। নিজ নিজ দেশের আইন-শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তারা যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সত্য কিন্তু মানুষ হত্যার সিদ্ধান্ত নিশ্চয় নিতে পারেন না।
এ সিদ্ধান্ত নেয়াটা কোন সভ্য সমাজের সংস্কৃতি হতে পারে না। ফেলানী তো চোর নয়, সে এমন কিছু চুরি করে বা কোন সহিংস ঘটনা ঘটিয়ে ফিরছিল না। তাকে এই অবৈধ পথে যাতায়াত করার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত, গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়া যেত। কিন্তু গুলি ছুড়ে হত্যা করে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে দেয়া হলো কেন ? কোন সিন্ধান্তে ? কোন আইনে ? সে আইনে তো পাচারকারী ব্যবসায়ী ও দালালরা মরে না ? কিশোরী ফেলানী কী এমন মহা অপরাধ করেছিল যে তাকে মেরে ফেলা হবে ?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন